বৈদেশিক কর্মসংস্থানে রিক্রুটিং এজেন্সির ভূমিকা ও বাস্তবতা: মোবারক উল্ল্যাহ শিমুল

- আপডেটের সময় : ১২:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
- / 162
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট শ্রমবাজারের জন্য এক সংকটপূর্ণ ও অনিশ্চিত সময় নিয়ে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা, ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত,নতুন করে কোভিড সংক্রমণের ঢেউ এবং বৈদেশিক শ্রমবাজারে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ভবিষ্যৎ এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা,দুর্বল নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার ঘাটতি, যা পুরো খাতকে এক প্রকার দিশাহীনতায় ফেলে দিয়েছে।
মালয়েশিয়া শ্রমবাজার: আশা ও বাস্তবতার তীব্র ফারাক:
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. আনোয়ার ইব্রাহিমের ঢাকা সফর ঘিরে একসময় আশার বীজ বোনা হয়। আলোচনায় উঠে আসে ১৭ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর ঘোষণা। কিন্তু বাস্তবতা হল—মাসের পর মাস কেটে গেলেও এখনো একজন শ্রমিকও মালয়েশিয়ার মাটিতে পা রাখতে পারেননি। এই পুরো উদ্যোগটি আজ পরিণত হয়েছে একটি রাজনৈতিক প্রদর্শনীতে ফলাফল শূন্য, হতাশাজনক।
পরবর্তীতে উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সফর ও দুই দেশের যৌথ কারিগরি-কমিটির বৈঠক হয় ঠিকই,তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—এটা কি বাস্তব অগ্রগতির,ইঙ্গিত নাকি শুধুই লোকদেখানো আশ্বাস?
সৌদি আরব: নিভে আসা এক সমৃদ্ধ বাজার:
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ছিল সৌদি আরব। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই দরজা যেন বন্ধ হয়ে আসছে। পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে বাজার উন্মুক্ত হলেও কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি কোন কৌশল না থাকায় এটি এখন স্থবির অবস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বিবেচনায় সামনে বড় ধরনের ধাক্কার আশংকা ক্রমেই প্রবল হচ্ছে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া: সম্ভাবনা আছে,তবে পথ দীর্ঘ:
জাপান ১ লক্ষ শ্রমিক নেওয়ার আগ্রহ দেখালেও, প্রক্রিয়াটি চরম ধীরগতির ও জটিল। এক একজন শ্রমিকের যাত্রা বাস্তবে সম্পন্ন হতে গড়ে লাগে প্রায় ২ বছর। অন্যদিকে, দক্ষতা ও ভাষার ওপর জোর দেওয়া দক্ষিণ কোরিয়াতেও প্রবেশের শর্তগুলো সাধারণ শ্রমিকদের জন্য একটি চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ। ফলে সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবায়নের পথে রয়েছে অসংখ্য বাধা।
প্রাইভেট সেক্টরের দিশেহারা অবস্থা ও এনজিও-নির্ভরতা:
জনশক্তি রপ্তানিতে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে আসা প্রাইভেট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো আজ কার্যত দিশেহারা। সরকারের সঙ্গে অংশীদার কিছু এনজিওর অসংলগ্ন কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের অদক্ষতা পুরো ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি একযোগে আইন মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে—ফলে এই খাতে মনোযোগী নেতৃত্বের অভাব প্রকট।
ব্যবসায়ীদের হতাশা ও সম্ভাব্য উত্তরণ: এখনই সময় জেগে উঠার:
এই বাস্তবতায় জনশক্তি রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু হতাশার গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এখনই প্রয়োজন বাস্তবমুখী, দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ তুলে ধরা হলো—
১. নেতৃত্বে একাগ্রতা ও মনোযোগ নিশ্চিত করা
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মনোযোগী নেতৃত্বে পরিচালনা করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
২. দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ প্রণয়ন
৫-১০ বছরের একটি সুস্পষ্ট, ডাটা-নির্ভর এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে—যার মাধ্যমে নির্ধারিত বাজার অনুযায়ী শ্রমিক প্রস্তুত ও প্রেরণ সম্ভব হবে।
৩. প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয়
প্রতিযোগিতা নয়, বরং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এনজিও ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের উচিত তদারকি ও নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় থাকা।
৪. স্কিল ও ভাষা প্রশিক্ষণ
বিশ্ববাজারে সফল হতে হলে শ্রমিকদের স্কিল, প্রযুক্তি জ্ঞান এবং ভাষা শেখার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। একটি জাতীয় প্রশিক্ষণ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সরকার, প্রাইভেট সেক্টর এবং এনজিওরা যৌথভাবে কাজ করবে।
শেষ কথা:
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স। অথচ এই খাত আজ স্থবিরতা, নীতিহীনতা ও দিশাহীনতার কবলে। সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে—এখনই যদি দৃঢ় নেতৃত্ব, বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ও আন্তরিক উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে শুধু প্রবাসী শ্রমিক নয়, পুরো দেশের অর্থনীতি পড়বে এক গভীর সংকটে।
এখনও সময় আছে—সঠিক সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই খাতকে আবারও গতিশীল করা সম্ভব।
লেখক: কে এম মোবারক উল্ল্যাহ শিমুল, বায়রা নেতা ও বিশ্লেষক