প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান কারিগরি প্রতিষ্ঠান জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো- বিএমইটি’র শীর্ষ পদসহ বেশ কিছু পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে| প্রতিষ্ঠানটির মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও রদবদল হয়েছে| এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত ইস্যুতে জরুরি এক সভায় দীর্ঘ সময় আলোচনা হয় বিএমইটি ইস্যুতে| সেই বৈঠকে বিএমইটির সার্ভার জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। এমন বাস্তবতায় নতুন মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেয়া সালেহ আহমদ মোজাফফর এর সামনে রয়েছে শুদ্ধি অভিযান, কোটি প্রবাসীর তথ্য সম্বলিত সার্ভারের সুরক্ষা নিশ্চিত করাসহ নানা চ্যালেঞ্জ|
মন্ত্রণালয়ের যেকোনো প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বন্ধে এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিদেশগামী কর্মী, প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সেবা নিশ্চিত করতে বরাবরই কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া প্রতিটি বিষয়ই দ্রুত সময়ে ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থাও নিয়েছেন তারা তবে বিএমইটির ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়ার কিছুদিন বিরতির পর ভিন্ন কৌশলে আবার অনিয়মের অভিযোগ উঠে

মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে দপ্তরে যোগ দেন বিএমইটির নতুন মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর| নানা আলোচনা- সমালোচনার মধ্য দিয়ে বিএমইটি থেকে বদলি করা হয় (সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক) মো. শহীদুল আলম এনডিসিকে| তিনি এখন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের মহাপরিচালক| আর বিএমইটি’র নতুন মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর ছিলেন জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালকের দায়িত্বে। এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আলাদা প্রজ্ঞাপনে এই বদলির আদেশ দেয়া হয়|
বিএমইটি সূত্র জানিয়েছে, দপ্তরে যোগ দেয়ার পর কর্মকর্তাদের তিনি বলেছেন, বিদেশগামী কর্মী, প্রবাসী, রিক্রুটিং এজেন্সিসহ সেবা প্রত্যাশী সকলের জন্য সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করতে হবে| এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও মর্যাদা দিন দিন বৃদ্ধি করাই সকলের দায়িত্ব| সেই বিষয়ে খেয়াল রেখে সকলকে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কাজ করার আহ্বান জানান বিএমইটির নতুন মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর| তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রেমিট্যান্সের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর সেই রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতাও বাড়াতে হবে

এদিকে, ১৭ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান, বায়রাসহ খাত সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সেই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়| বৈঠকে বিএমইটির সার্ভার জালিয়াতিসহ সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত অনিয়মগুলোর বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া|
বৈঠকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিএমইটির সাম্প্রতিক সার্ভার জালিয়াতির ঘটনায় একজনের নামে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, বাকিদের নামে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি- সেই প্রশ্ন তোলা হয়| প্রতিষ্ঠানটির সার্ভার সুরক্ষা নিশ্চিত করা, সার্ভার জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে| এছাড়া সাম্প্রতিক অনিয়মের ঘটনায় করা মামলার দুর্বল ধারা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বিদেশে কর্মী পাঠানোর খরচ বেশি কেন সেই প্রশ্ন তোলেন মুখ্য সচিব খরচ কমানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেন তিনি ২০১৩ সালের অভিবাসী আইন অনুযায়ি একটি নিরাপদ ডাটাব্যাংক নিশ্চিত করা এবং সেই ডাটাব্যাংক থেকে কর্মী পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়
কারিগরি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিএমইটির পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের জন্য গেল কয়েক বছর বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। সেগুলো মধ্যে, একটি শক্তিশালী ডাটা ব্যাংক গড়ে তোলা ছিল অগ্রাধিকার তালিকায়। কিন্তু মালয়েশিয়া শ্রমবাজার সামনে রেখে ডাটাব্যাংক থেকে এবং সম্পূর্ণ অনলাইন পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি থেকে। কিন্তু কয়েক লাখ কর্মী বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের প্লাটফর্মে নিবন্ধন করলেও সয়ংক্রিয়ভাবে কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। এতে করে প্রতারিত হয়েছেন বলে মনে করছেন কর্মীরা। অনলাইনে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের আবেদনের উদ্যোগ নেয়া হলেও এই প্রযুক্তিতেও নেয়া হয়েছে বেসরকারি সহায়তা। ফলে তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি বিবেচনায় রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা এই পদ্ধতিতেও আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। তবে সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক এসব বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
আবার উপজেলা পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র- টিটিসি উদ্বোধন করা হলেও পরিপূর্ণ কার্যক্রম শুরু হয়নি। প্রবাসী ও তাদের পরিবারের অভিযোগ গহণ এবং সমাধানে বিএমইটির গুরুত্ব নেই বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। আবার কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বাড়ানোকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে, মানের ক্ষেত্রে বা নিরাপদ কর্মপরিবেশের দিকে নজরই দেয়া হয়নি। এমন নানা দাপ্তরিক সমন্বয়হীনতা ও সংকট সমাধানে নতুন মহাপরিচালককে নিতে হবে বাড়তি চাপ।

এছাড়া, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সাম্প্রতিক সময়ে বিএমইটি আলোচনার কেন্দ্রে। খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বছরের পর বছর চলতে থাকা অনিয়ম বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না নতুন মহাপরিচালকের জন্য| কারণ, প্রতিষ্ঠানের ভিতরের বেশ কয়েকজন সরাসরি অনিয়মের সাথে জড়িত। বহিরাগত কয়েক ব্যবসায়ীর সাথে যুক্ত হয়ে গঠিত ‘চক্র’ বিএমইটিকে অনেকটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রেখেছে | এই ‘চক্র’ থেকে বের করে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা নতুন মহাপরিচালকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন এই খাতের বিশ্লেষকরা|
এই চক্রের নানা অনিয়ম এবং প্রথমবারের মতো ‘চক্রের মূল হোতাদের’ নাম ও পরিচয় সম্প্রতি উঠে আসে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সার্ভার জালিয়াতি এবং গভীর রাতে বিএমইটি’র কার্যালয়ে চক্রের হোতাদের অবাধ কর্মকান্ড উঠে আসে| মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভুয়া ভিসায় ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ইস্যু করা এবং কর্মীদের ফ্লাইট হলেই সেই তথ্য মুছে ফেলার বিষয়টিও তথ্য প্রমাণসহ তুলে ধরা হয়| এমনকি প্রচলিত শ্রমবাজারের বাইরের ৮৩ দেশের জন্য ঘুষের ফি নির্ধারণ করে চক্রটি| সাধারণ ব্যবসায়িরা অনেকটা জিম্মি ছিল তাদের কাছে।

বিএমইটি’র সার্ভার জালিয়াতি, বেআইনিভাবে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স দেয়াসহ নানা অনিয়মের এই চক্রের বহিরাগত ৪ সদস্যের মধ্যে- দ্যা ইফতি ওভারসিজ এর মালিক মো. রুবেল, কিউ.কে. কুইক এক্সপ্রেস রিক্রুটিং এজেন্সির রবিউল ইসলাম রবিন, এইচ পি ইন্টারন্যাশনালের প্রবীর বনিক ও মাস্ক রুবেল। এই ৪ জনের নামে অনিয়মের অভিযোগ, তথ্য ও প্রমাণসহ পরিচয় প্রকাশ করা হয় সেই প্রতিবেদনে। এছাড়া আরো অন্তত ৩ টি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের নাম জানা গেছে এই চক্রের সদস্য হিসেবে।
এসব অনিয়মের প্রকাশ পাওয়া, মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও তখনকার মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম এনডিসি বারবার অস্বীকার করে ভিন্ন ব্যাখ্যাও দাঁড় করাতে চান গণমাধ্যমের সামনে এসব নিয়ে সমালোচনাও হয় মন্ত্রণালয়ের ভিতরে-বাইরে এমন টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে বদলি আদেশ পান তিনি
অবাক বিষয় হলো, এতো বড় জালিয়াতি, সার্ভার থেকে প্রবাসীদের তথ্য গায়েব করে ফেলা হলেও বিএমইটির কোন কর্মকর্তা- কর্মচারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। আর চলতি বছরের জুনে মালয়েশিয়ার ঘটনা তো আরো ভয়াবহ। ছুটির দিনে, এমনকি ঈদের ছুটি এবং রাত ১২ টার দিকে ক্লিয়ারেন্স ইস্যু ও প্রিন্ট করা হয়েছে। বিএমইটির কর্মকর্তা ও কর্মচারি যুক্ত না থাকলে সার্ভারে প্রবেশ করে এবং ছুটির দিন ও গভীর রাতে এমন জালিয়াতি করা সম্ভব ছিল না। তবুও কেন বিএমইটির ভিতরের কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, সেই প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মাঝে। এমন বাস্তবতায় অগোছালো প্রতিষ্ঠানের ইমেজ ফিরিয়ে আনা ও বৃদ্ধি করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে বিএমইটির নতুন মহাপরিচালককে
মিরাজ হোসেন গাজী, সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাভিশন ও ফাউন্ডার, প্রবাস তথ্যকেন্দ্র।