তীব্র কর্মী সংকটে পড়েছে মালয়েশিয়া। এ মুহূর্তে দেশটিতে উত্পাদন, পাম প্ল্যান্টেশন এবং নির্মাণ খাতে মালয়েশিয়ায় অন্তত ১২ লাখ শ্রমিকের ঘাটতিতে রয়েছে। সরকারি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মহামারীর বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় পরিস্থিতি যত স্বাভাবিক হচ্ছে, কর্মী সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।
এর মধ্যে কারখানাগুলোতে দরকার অন্তত ৬ লাখ শ্রমিক। নির্মাণ শিল্পে সাড়ে ৫ লাখ, পাম তেল শিল্পে এক লাখ ২০ হাজার, চিপ উৎপাদন শিল্পে ১৫ হাজার কর্মী প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী চিপের ঘাটতি থাকার পরও মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলো যোগান বাড়াতে পারছে না। এমনকি মেডিকেল গ্লাভ তৈরির কারখানাগুলোও উৎপাদন বাড়াতে পারছে না, এ খাতে অন্তত ১২ হাজার শ্রমিক প্রয়োজন।
পাম তেলের বাগান থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর কারখানাগুলো তীব্র শ্রমিক সংকটের কারণে নতুন অর্ডার নিতে পারছে না। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পণ্যের অর্ডার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হুমকির মুখে পড়েছে।
স্থানিয় ব্যবসায়ী ও কূটনীতিকদের ভাষ্য মতে রয়টার্স ও মালয় মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড মহামারী শুরুর পর বিদেশি শ্রমিক আনার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা মালয়েশিয়া সরকার দিয়েছিল, গত ফেব্রুয়ারিতে তা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু অনুমোদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং শ্রমিকের সুরক্ষা নিয়ে ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের সাথে আলোচনায় ধীর গতির কারণে খুব বেশি বিদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় ফিরতে পারেনি।
রপ্তানি-নির্ভর দেশ মালায়েশিয়া গত কয়েক দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ দেশের কারখানা, পামবাগান এবং পরিষেবা খাত গড়ে উঠেছে মূলত বিদেশি কর্মীদের ওপর নির্ভর করে, কারণ মালয়েশীয়ানরা এসব কাজকে নোঙরা, ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর কাজ বলে মনে করেন। এদিকে মালয়েশিয়ার আয়ের এক চতুর্থাংশ আসে শিল্প খাতের উৎপাদন থেকে। কিন্তু এখন কর্মী সংকটে পড়ে এসব শিল্প কারখানার উৎপাদন থমকে আছে। কারখানা মালিকরা শঙ্কায় আছেন এভাবে ক্রেতা ফেরাতে হলে তারা হয়ত আর মালয়েশিয়ায় ফিরবেন না।
সাড়ে তিন হাজারের বেশি কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারী ফেডারেশন অব মালয়েশিয়ান ম্যানুফ্যাকচারার্সের সভাপতি সোহ থিয়ান লাই বলেন, “গত কিছুদিনে আশা জাগানোর মত অনেক বিষয় আছে, আমাদের বিক্রিও বাড়ছে। কিন্তু আমাদের অনেক কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে।”
বিশেষ করে পাম তেল কোম্পানিগুলো খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে বলে ইউনাইটেড প্ল্যান্টেশনের প্রধান নির্বাহী পরিচালক কার্ল বেক-নিলসেনের ভাষ্য। তিনি বলেন, “পরিস্থিতি খুব খারাপ। বিষয়টা অনেকটা এরকম, আপনাকে ১১ জনের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলতে হবে, কিন্তু আপনার দলে মাঠে নামার মত আছে কেবল সাতজন।”
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স এপ্রিলের ৫১.৬ পয়েন্ট থেকে মে মাসে ৫০.১ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ২০২০ সালের অগাস্টের পর সেখানে কর্মী কমেছে সবচেয়ে বেশি, ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির গতি থমকে গেছে।
মালয়েশিয়ার সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওং সিউ হাই বলছেন, কর্মীর অভাবে তাদের চিপ তৈরির কারখানাগুলোকে ক্রেতা ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। মালয়েশিয়ার মানুষ এ ধরনের কারখানায় কাজ করতে চায় না। যারা কাজে ঢোকে, তারাও ছয় মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেন।
দেশটির অর্থনীতিতে পাম তেলের অবদান ৫ শতাংশ। কিন্তু শ্রমিকের অভাবে সময়মত তুলতে না পারায় অনেক ফল এবার গাছেই পচেছে। তাতে এ বছর উৎপাদন ৩০ লাখ টন কমে যেতে পারে, তাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ বিলিয়ন ডলার। শ্রমিক সংকট অব্যাহত থাকলে রাবার গ্লাভ শিল্প এ বছর ৭০ কোটি টাকার আয় হারাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই শ্রমিক সংকটের মালয়েশিয়ায় অর্থনীতি কতটা ক্ষতির মুখে পড়ছে, সে বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেয়নি দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়, যারা বিদেশি কর্মী নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন করে। গত এপ্রিলে মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারভানান বলেছিলেন, বিভিন্ন খাতে চার লাখ ৭৫ হাজার বিদেশি কর্মীর চাহিদার বিপরীতে মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে ২ হাজার ৬৫ জন কর্মীকে। যারা অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়েছে বা যেসব ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার নিয়ম মানা হয়নি, সেসব আবেদন নাকচ করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় বিদেশি শ্রমিকের দুই বড় উৎস ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলেছেন, তাদের কাছে শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে, এ কারণেও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে কর্মী পাঠানর বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া কর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, বাংলাদেশ তাতে আপত্তি তোলায় বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছে।বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলছেন, মালয়েশিয়া সরকারের পরিকল্পনা মাফিক শ্রমিক পাঠাতে গেলে তাদের খরচ বাড়বে এবং সেই টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কর্মীরা ঋণের জালে পড়বে।
বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য শ্রমিকদের কল্যাণ এবং অধিকার রক্ষা করা। সেখানে গিয়ে তারা মানসম্মত মজুরি, উপযুক্ত বাসস্থান পাক, আমরা সেটা নিশ্চিত করতে চাই। বিদেশে যাওয়ার খরচ যাতে কমে আসে, অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা যেন তারা পায়, আমরা সেটাই চাইছি।” তিনি আরও বলেন, মালয়েশিয়া এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ কর্মী নিতে চায়। তবে তারা ঋণের ফাঁদে পড়ুন, সেটা বাংলাদেশ চায় না।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত দুই বছরে মালয়েশিয়ার সাতটি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কারণ শ্রম শোষণ ও কর্মীদের নিপীড়নের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ারন রাষ্ট্রদূদত হারমোনো বলেছেন, দুই দেশের সাম্প্রতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি এসেছে। তবে মালয়েশিয়ার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ক্রুটি আছে- এমন অভিযোগ মানতে রাজি নন দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারভানান।
চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, তার দেশ বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বাস দিয়েছে, শ্রমিকদের ভালো বেতনের পাশাপাশি তাদের অধিকারের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। শ্রমিক নিয়োগের প্রযুক্তিগত বিষয় এবং নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে গত সপ্তাহে কয়েকটি দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সরকার চুক্তি করেছে বলেও জানান সারভানান।