প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিরা সাথে করে নিয়ে আসে নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, আচার আচরণ, ধর্ম, খাবার ইত্যাদি। কিন্তু দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদের ফলে সে সব ক্রমশঃ স্মৃতির পাতায় স্থান করে নেয়। আর খুঁজে ফেরে নিজ দেশের সব কিছু।
এ চাহিদা থেকেই গড়ে ওঠে বিভিন্ন দেশের নানান সংগঠন। তবে সবচেয়ে বড় সংগঠন নিজ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেখানে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় নিজ দেশকে। হয়ে ওঠে একমাত্র আশা ভরসার জায়গা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাস নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা, শিক্ষা এবং পর্যটন এর প্রসার করে থাকে যাকে বলে মিনি কান্ট্রি বা ছোট্ট দেশ।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কারণেই স্থায়ী দূতাবাস এবং সেখানে পূর্ণাঙ্গ বাংলাদেশকে উপস্থাপন করার নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে লক্ষ্যে কাজ করছেন। সম্পর্কের উন্নয়ন করতে এবং নিজ নাগরিকদের তৈরি করতে এর বিকল্প নেই।
মালয়েশিয়ায় হাইকমিশনে প্রতিদিন অসংখ্য সেবা প্রত্যাশী আসেন। পাশাপাশি বিদেশিরাও নানান প্রয়োজনে আসেন। তাঁদের সবার কাছে দূতাবাস হতে পারে ইতিহাস, সংস্কৃতি, পর্যটন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের উত্তম রিসোর্স সেন্টার।
২০১০ ও ২০১৪ সালে মালয়েশিয়া সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দূতাবাসে কেউ আসলে যেন মনে করে নিজ দেশে এসেছে এমন পরিবেশ করতে হবে। সম্প্রতি ব্রুনাই সফরেও একই কথা বলেছেন তিনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়া সফরে এসেছিলেন। তিনি তৎকালীন রাজা কিং আব্দুল হালিমের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেবার জন্য ধন্যবাদ দেন। সেই থেকে মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক অনেক মজবুত ভিত্তি পায়। কালক্রমে মালয়েশিয়ায় আগমন ঘটে সাধারন কর্মী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন উচ্চতর পেশায় দক্ষ জনবলের।
ফলে দেশটিতে প্রায় দশ লক্ষাধিক বাংলাদেশি নাগরিকের অবস্থান আছে বলে ধারনা করা হয়। এদের খুব অল্প সংখ্যক পরিবার পরিজন নিয়ে অবস্থান করেন। কিছু সংখ্যক বিয়ে শাদী করে এখানেই রয়ে গেছেন। এভাবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্ম বেড়ে উঠলেও তাঁরা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সম্পর্কে শেখার কোন মাধ্যম পাচ্ছে না। দেশকে জানার ও বুঝবার ঘাটতি রয়েই গেছে। তবে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময় ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস শিক্ষা দেবার প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে না।
কুয়ালালামপুর নগরে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ এসোসিয়েশন বৈশাখী মেলা উদযাপন করে পাশাপাশি বিডি এক্সপাট নামক একটি গ্রুপ ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চা করে থাকে খুব সীমিত পরিসরে। তবে সকলের আশা আছে ভালো একটি প্রতিষ্ঠানের।
মালয়েশিয়ায় ভারতের ইন্দিরাগান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার, দুবাই মার্কেট, ইরাকী স্কুল আছে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশ সেন্টার করার। যেখানে বঙ্গবন্ধু কর্নার, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা, বিনিয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কে পুর্নাঙ্গ ধারনা ও চর্চা করার। আশার আলো নিয়ে এসেছে দূতাবাসের বঙ্গবন্ধু কর্নার। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’ করা হয়েছে, তবে পরিপূর্ণতা এখনও আসেনি। প্রত্যাশার সাথে বাস্তবতার ফারাক রয়ে গেছে।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিবসে দূতাবাসের রিসিপশনের বাম পাশে পরিপাটি করে সাজানো হয় বঙ্গবন্ধু কর্ণার ও লাইব্রেরি। বঙ্গবন্ধু কর্নারে স্থাপিত ছবিগুলোর মাধ্যমে সীমিত পরিসরে বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সার্বিক চিত্র ফুটে উঠেছে।
এটিকে আরো বড় আকারে রুপ ধারনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নানামুখী কর্মকান্ডের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে চিত্র, অডিও এবং ভিজুয়াল ব্যবস্থা সংযোজন করতে হবে বলে জানান মালয়েশিয়ায় নব গঠিত বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ডা: এ টি এম এমদাদুল হক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া যথাক্রমে দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দুটি মুসলিম দেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারী মালয়েশিয়া প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। অতঃপর ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মালয়েশিয়া সফর করেন এবং ১৯৭৪ সালে তৎকালীন মালয়েশিয়ার রাজা তুয়াংকু আব্দুল হালিম বাংলাদেশ সফরে যান। তখন থেকেই মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। মালয়েশিয়ার সকল উন্নয়নে সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের ছোঁয়া বিরাজমান। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে প্রায় দশ লক্ষাধিক শ্রমিক মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ও পারস্পরিক সহযোগিতার নয়া দিগন্ত উন্মোচনের পরিকল্পনা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনকে নূতনভাবে সাজানোর এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদান নিশ্চিতকরনের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
‘মামা’ সাংস্কৃতিক শিল্পিগোষ্টীর প্রতিষ্ঠাতা এমদাদুল হক সবুজ বলেন, দূতাবাসে ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র এবং লাইব্রেরি স্থাপন করা যেতে পারে। এসব দ্রুত চালু করতে দূতাবাসের সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
তবে বঙ্গবন্ধু কর্নার এর বাকী কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে মালয়েশিয়ায় করোনা ভাইরাস এখন অন্যতম বাধা হয়ে দাড়িয়েছে।
দূতাবাসের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুপ্রেরণা, তাঁর অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ই আমরা আজ স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই আমরা দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধামুক্ত, সুখী, সমৃদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার।
প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা একটু একটু করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এই উন্নয়নে প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু কর্নারকে আরো বৃহত্তর পরিসরে উপস্থাপন করার কাজ চলছে।‘ খুব শিঘ্রই বঙ্গবন্ধু কর্ণাও উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার তথা টুইন টাওয়ারের নিকটবর্তী বর্তমান দূতাবাসের স্থানটি ক্রয় করার জন্য ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন ফলাফল পাওয়া যায় নি। তবে প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবী দূতাবাসের স্থায়ী ঠিকানা হবে।
বর্তমান স্থানটি যোগাযোগের দিক থেকেও খুব সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বর্তমান স্থানটি ক্রয় করা হলে দূতাবাসের অফিস ছাড়াও বৃহত্তর পরিসরে বঙ্গবন্ধু সেন্টার, লাইব্রেরি, হলরুম, প্রদর্শনী সেন্টার, বাংলাদেশ স্কুল, সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, বাণিজ্য কেন্দ্র, পর্যটন কেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন করা সম্ভব হবে বলে অনেকের ধারনা।
বর্তমানে পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়া সরকারের দেওয়া প্লটটির আশেপাশে কোন দেশই দূতাবাস স্থাপন করেনি। কেননা কুয়ালালামপুর থেকে দূরে এবং বিকাল থেকে এলাকাটি বিরান হয়ে যায়। যোগাযোগের দিক থেকেও অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে অর্থাৎ সেখানে যেতে হলে ব্যক্তিগত গাড়ি বা ট্যাক্সিতে করে যেতে হবে। আশেপাশে খাবার রেস্তোরা এবং থাকার কোন হোটেল নেই। ফলে একজন প্রবাসীকে কুয়ালালামপুর থেকে পুত্রজায়া যেতে হবে এবং কাজ শেষ করে আবার কুয়ালালামপুরে ফিরে আসতে হবে এতে সারাদিন লেগে যাবে।
পুত্রজায়ায় জায়গা থাকা সত্বেও উপযুক্ত না হওয়ায় শ্রীলংকা কুয়ালালামপুরেই জায়গা কিনে দুতাবাস করেছে। বাংলাদেশের লোকসংখ্যার প্রেক্ষিতে এবং ভালোভাবে সেবা দেওয়া এবং বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য কুয়ালালামপুরে একটি স্থায়ী দুতাবসের ঠিকানা হবে বলে প্রবাসীরা আশা করেন।