ইটালী প্রবাসীরা ”ফাক দিস কান্ট্রি” বলায় যারা মনে কষ্ঠ নিয়েছেন,তাদেরকে আমার সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা ভান্ডার থেকে একটা গল্প বলি:
ফরিদপুরের ছেলে কবির হোসেন।সপ্তম শ্রেনীতে পড়তো। বাবা মা ভাই বোন নিয়ে কৃষি পরিবার তাদের।টানাটানির সংসার,তবুও মোটামুটি চলছিলো তাদের। গ্রামের এক প্রবাসী তাকে বলেছিলো পশ্চিমে গেলে অনেক টাকা। পশ্চিমে মানে ইউরোপ গেলে সংসারে অভাব থাকে না।
সেসময় একদিন বাবার বকুনী খেয়ে তার মন খারাপ হয়। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বাস ষ্ট্যান্ডে। তারপর চড়ে বসে যশোহর গামী বাসে।তার পকেটে তখন মাত্র ১৭টি টাকা। তারপর বেনাপোল হয়ে ইন্ডিয়ার বিভিন্ন জনপদ হয়ে পাকিস্তানের করাচীতে। এই দীর্ঘ আড়াই হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে তার সময় লেগেছে ২ বছর।উড়োজাহাজে গেলে যেথানে সময়
লাগতো বড় জোড় ৫ঘন্টা।মাত্র ১৭ টাকা পকেটে নিয়ে সে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলো কিভাবে? খেয়েছে কি? অবাক হবারই কথা। পথে সে রেষ্টুরেন্টে থালা গ্লাস মাজা থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যা সে করেনি।করাচী গিয়ে সে একটা পোষাক কারখানায়
হেলপার পদে কাজ নেয়। টানা ৩ বছর চাকুরী করে টাকা জমায়।দালালের মাধ্যমে পাকিস্তানী পাসপোর্ট তৈরী করে।তারপর দালালের মাধ্যমেই ভিসা নিয়ে যায় তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। সেখানে গিয়ে ছোট খাটো কাজ করে।কখনো খেয়ে, আবার কখনো না খেয়ে টাকা জমায় রমযান।তার লক্ষ একদিন সে ইউরোপ যাবে।ইউরোপ গেলেই অনেক টাকার মালিক হতে পারবে সে। ইউরোপ কিভাবে যাবে, কোন কোন দেশ নিয়ে ইউরোপ সে জানতো না। আর কতদিন পর সে ইউরোস যেতে পারবে তাও জানতো না রমযান। চলতে লাগলো নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা।
ইস্তাম্বুল শহরে মানুষের ফুট ফরমাস খাটে আর পথ খুজে গ্রীস যাওয়ার।একদিন পেয়েও যায় পথ। দালালের সাথে শুরু হয় পায়ে হেঁটে গ্রীস যাত্রা। সীমান্ত রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইস্তাম্বুল থেকে গ্রীসে ঢোকার সুবিধাজনক সময় শীতকাল।এসময় তূষারপাত হয়।তূষারে ঢেকে যায় পথ ঘাট,পাহাড় সব কিছু সময় কিছুটা ঢিলেঢালা ডিউটি করে।এমনই একটা সময় কবির হোসেনের মত কয়েকজনকে নেয়ে রওনা হয় দালালরা।হাঁটতে হাঁটতে বরফে পা দেবে যায়। পায়ের বোধ শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।দালালরা তাকে বোঝায় এই তো আর দিছুদুর যেতে পারলেই তোমার স্বপ্নের গ্রীস।তাগিদ দেয়”পা চালাও”। কখনো ধমকে উঠে হয় পা চালাও না
হয় পুলিশের হাতে ধরা পড়বে। শুধু মনের জোড়ে পা চালায় কবির।এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ২৪/২৫ বছরের যুবক কবির।জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করে গ্রীসের একটি হাসপাতালের সাদা দূগ্ধ ফেননিভ বিছানায়।
কবির হোসেনের সাথে এই লেখকের পরিচয় হয় ১৯৯৪ সালে, গ্রীসের রাজধানী এ্যাথেন্সে। সে তার গ্রীস আগমনের গল্প বলতে গিয়ে বুকে থাপ্পর দিয়ে বলে-”বাংলাদেশী পাসপোর্টে আমার ছবি লাগে নাই,বিমানের ভেতরটা কেমন তা কখনো দেখা হয় নাই।তবুও আমি এখন ইউরোপে থাকি।থাকা খাওয়া শেষে মাসে ৪/৫শত ডলার দেশে পাঠাই”।
এটা গল্প না সত্য ঘটনা। লক্ষ লক্ষ প্রবাসী বাঙ্গালীর বিদেশ যাত্রায় কমবেশী এরকমই ঝুঁকি নিতে হয় তাদের।এদের ঘামে, রক্তে, দীর্ঘশ্বাসে অর্জিত রেমিটেন্সে চলে দেশে থাকা স্বজনদের সংসার,বাবুয়ানা,জমি ক্রয়, বাড়িঘর নির্মান। বিনিময়ে প্রবাসী স্বজন পায়না জমির মালিকানা এমনকি ন্যূনতম ভালো আচরনও পায়না তারা। স্বজনদের কাছ থেকে।এখানেই শেষ না। প্রবাসীরা দেশে এলে বিমান বন্দরে নানা অসৌজন্যমূলক আচরনের সম্মুখীন হয়। সূতরাং প্রবাসীদের মনে ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক।তাদের গালি দেওয়ার আগে চোখ বন্ধ করে ভাবুন এরকম কষ্ঠের কথা।
লেখক:-সাংবাদিক, বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমনকারী।
email:-mirfaruk579@gmail.com